Header Ads Widget

Responsive Advertisement

মৃত্তিকা গঠনের উপাদানসমূহ বা নিয়ন্ত্রকসমূহ [Factors or elements of soil formation] আলোচনা করো

মৃত্তিকা গঠনের উপাদানসমূহ বা নিয়ন্ত্রকসমূহ [Factors or elements of soil formation] 


ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র একই ধরনের মাটি দ্বারা গঠিত নয়। মাটি সৃষ্টির প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ভৌগোলিক শর্তাবলীর উপর ভিত্তি করে মাটি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলির যৌথ মিথস্ক্রিয়ার [একাধিক প্রক্রিয়ার সংমিশ্রণ] প্রভাবে নতুন নতুন মাটির সৃষ্টি হয়। সুতরাং মৃত্তিকা সৃষ্টির সম্পূর্ণ প্রণালীটি কয়েকটি ভৌগোলিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল । সেজন্য মৃত্তিকা গঠনে বিজ্ঞানীগণ যেসব শর্ত বা নিয়ন্ত্রকগুলির কথা উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- 

ডকুচেভ [Dokuch] প্রদত্ত উপাদান : 1954 সালে রুশ মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডকুচেভ মুক্তিকার গঠন সংক্রান্ত চারটি নিয়ন্ত্রকের কথা বলেন। যথা- (i) জলবায়ু (ii) জীবজগৎ  (iii) আদিশিলা  এবং (iv) সময় । মাটি গঠনের বিভিন্ন উপাদানগুলির কার্য-কারণ পরীক্ষা করে ডকুচেভ যে সমীকরণটি প্রকাশ করেন তা হল- S = f (CL, O, P, t)। এখানে s = মৃত্তিকা (soil), f = কার্যকারণ (function), Cl = জলবায়ু (climate), O = জীবজগৎ (organism), P = আদিশিলা (parent material), t = সময় (time) 

জেনি প্রদত্ত সমীকরণ : পরবর্তীকালে এইচ. জেনি [H. Jenny, 1954, 1958] ডকুচেভের চারটি নিয়ন্ত্রক ছাড়াও মৃত্তিকা গঠনে ভূমিরূপের [relief = r] গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তাঁর মতে, ভূমিরূপের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যেরও পরিবর্তন ঘটে। এজন্য জেনি-র মতে, মৃত্তিকা সৃষ্টির পাঁচটি কারণ রয়েছে। মৃত্তিকা সৃষ্টির বিষয়ে জেনি প্রদত্তসমীকরণটি হল—S = f (CI, O, P, r, t) 

জে. এস. জফি [J. S. Joffe, 1936] : জে. এস. জফি [1936] মৃত্তিকা গঠনের প্রভাবগুলিকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করেছিলেন সেগুলিকে বর্তমানে মৃত্তিকা গঠনের উপাদান বা নিয়ন্ত্রক বলা যেতে পারে। এগুলি হল -

মৃত্তিকা গঠনের উপাদানসমূহ বা নিয়ন্ত্রকসমূহ


[A] সক্রিয় বা প্রত্যক্ষ কারণ বা উপাদানসমূহ [Active Factors or Elements]

(a) জলবায়ু [ Climate]] : জলবায়ুর দ্বারা কোনো স্থানের মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রকৃতি ও হার নিয়ন্ত্রিত হয়। জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদানগুলি স্বাভাবিকভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যেমন- 

(1) মৃত্তিকা গঠনে আর্দ্রতার বা বৃষ্টিপাতের প্রভাব :(i) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ক্ষরণের মাত্রা বেশি বলে মাটি অম্ল প্রকৃতির [pH কম] হয়। আবার কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ক্ষরণের মাত্রা কম হয় বলে মাটি ক্ষার প্রকৃতির [pH বেশি। হয়। (ii) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে হাইড্রোজেন আয়নের গাঢ়ত্ব বেড়ে যায় (iii) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে মাটিতে স্বাভাবিক উদ্ভিদের পরিমাণ বেড়ে যায় বলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হয়। (iv) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে মৃত্তিকার স্তরগুলি শুরু হওয়ার ফলে গভীর মাটির স্তরের সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যত বেশি হয় মৃত্তিকার স্তরগুলি তত পুরু হয় বলে মৃত্তিকাও অধিক পুরু হয়। (v) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে মাটির উপরের স্তর থেকে ক্যালসিয়াম, -ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম প্রভৃতি দ্রবণীয় ক্ষারকীয় পদার্থগুলি অনুস্রবর্ণ-এর সাহায্যে ধৌত প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয়। আবার বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এই ক্ষারকীয় পদার্থসমূহ মাটির উপরের স্তরে সঞ্চিত হয়। ফলে মাটির উপরের স্তরে কেবলমাত্র অ্যালুমিনিয়াম ও লোহার অক্সাইড পড়ে থাকে এবং এধরনের মাটিকে পেডালফার [Ped Al-Fer) মাটি বলে । (vi) আবার বাষ্পীভবন অপেক্ষা বৃষ্টিপাত কম হলে কৈশিক প্রক্রিয়ায় মাটির নীচের দিক থেকে ওপরের দিকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট ও লবণ উপরে উঠে আসে এবং ফলে পেডোক্যাল মাটির সৃষ্টি হয়।

II) মৃত্তিকা গঠনে তাপমাত্রার প্রভাব : তাপমাত্রা বা উন্নতা মৃত্তিকা গঠনের একটি বিশেষ উপাদান। ঋতুভেদে উন্নতার পার্থক্য ঘটে। এই কারণে ঋতুভেদে মৃত্তিকা সৃষ্টির হারেরও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ভ্যান্ট হয় [Vant Hoff, 1884] প্রদত্ত সূত্রানুসারে, প্রতি 10° সে. উদ্ধৃতা বৃদ্ধিতে মৃত্তিকায় রাসায়নিক বিক্রিয়া দুই কিংবা তিনগুণ বেড়ে যায় ।সুতরাং মৃত্তিকা গঠনে উয়তার প্রভাবগুলি হল- (i) ভ্যান্ট হফ-এর সূত্রানুসারে, শীতল মেরু অঞ্চলের তুলনায় উয় ক্রান্তীয় ও নিরক্ষীয় অঞ্চলে মৃত্তিকা সৃষ্টির হার দ্রুত। (ii) উষ্ণতা বাড়লে আবহবিকারের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে পুরু রেগোলিথ সৃষ্টি হয় ও মাটির গভীরতার বৃদ্ধি ঘটে (iii) উন্নতা বৃদ্ধি পেলে মাটিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।) উন্নতা বেশি হলে মাটিতে কাদা জাতীয় খনিজ যেমন- কেওলিনাইট, মন্টমোরিলোনাইট প্রভৃতির পরিমাণ বেশি হয়) (1) অধিক উষ্ণতা জনিত কারণে মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের মৃত্তিকা শুষ্ক ও লবণাক্ত হয়। 


 (b) জীবজগতের প্রভাব : মৃত্তিকা সৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। মৃত্তিকাগঠনে (I) উদ্ভিদজগৎ ও (II) প্রাণীজগৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করে।)

 (I) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে উদ্ভিদের প্রভাব :(i) শীতল জলবায়ু অঞ্চলে পাইন জাতীয় গাছের পাতায় ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি ধাতব উপাদান কম থাকে বলে এখানে মাটি বেশি অল্পপ্রধান (ii) তুমাচ্ছাদিত অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকে বলে মৃত্তিকা মৃদু ক্ষারকীয় হয়। (iii) উদ্ভিদের বর্জ্য দেহাবশেষ বিয়োজিত হয়ে মাটিতে হিউমাস রূপে সংযোজিত হয়, ফলে মাটির পুষ্টিগুণ বাড়ে ও মাটি উর্বর হয়। (iv) মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। (v) উদ্ভিদ মৃত্তিকার গঠন সুসংবদ্ধ করে দিল) উদ্ভিদের দেহাবশেষ দ্বারা মৃত্তিকার রং নির্ধারিত হয়। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মৃত্তিকার রং কালো হয়। (vii) উদ্ভিদের দেহাবশেষ মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তির বৃদ্ধি ঘটায়। 

II) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে প্রাণীজগতের প্রভাব : (i) মাটির গর্তে বসবাসকারী উই, পিঁপড়ে, কেঁচো, ছুঁচো প্রভৃতি মাটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে বলে মৃত্তিকা আলগা হয় ও বায়ু চলাচলে সাহায্য করে। (ii) কেঁচো মাটির নাইট্রোজেন ও ক্যালসিয়ামের বৃদ্ধি ঘটায় বলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। (iii) শামুক মৃত্তিকা সৃষ্টিতে উদ্ভিদের প্রভাব শিলায় জৈব পদার্থের সংমিশ্রণে সহায়তা করে এবং এদের দেহাবশেষ মাটিতে চুন বা ক্যালসিয়ামের বৃদ্ধি ঘটায়।


[B] মৃত্তিকা সৃষ্টির নিষ্ক্রিয় কারণ বা উপাদানসমূহ [Passive Factors]: 

[a] আদিশিলা বা জনকশিলা [Parent Materials} : মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এইচ. জেনি [H. Jenny]-এর মতে, আদিশিলা হল মৃত্তিকা প্রণালীর (সৃষ্টির) প্রাথমিক প্রণালী বা পদ্ধতি । আদিশিলা আবহবিকার, ক্ষয় ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে প্রথমে রেগোলিথ' গঠিন করে। পরে জলবায়ু ও বিভিন্ন জীবের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দ্রবণ, জলযোজন ও বিভিন্ন জারণ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। (1)মৃত্তিকার মূল উপাদান দ্বারা মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম, যথা— গ্রথন, কাঠামো, জলধারণ ক্ষমতা, বর্ণ, pH -এর মান প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য বিভিন্ন শিলায় বিভিন্ন ধরনের মাটি গঠিত হতে দেখা যায়। যেমন- গ্রানাইট ও নিস্ শিলায় ফেল্ডস্পারের পরিমাণ বেশি থাকলে কাদামাটি সৃষ্টি হয়, ব্যাসল্ট শিলা থেকে কৃমৃত্তিকা, ল্যাটেরাইট ও লাল মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়, চুনাপাথর ও মার্কেল থেকে রেনজিনা মাটি এবং সিলিকা-সমৃদ্ধ শিলা থেকে পড়সল মাটি গড়ে ওঠে। (2) আদি শিলার প্রভাব সর্বাধিক হলে এন্ডোডায়নামোমরফিক মাটির উৎপত্তি হয়, যেমন লিথোসল, রেগোসল ও অ্যালুভিয়াম। (3) খনিজ লবণ, চূনাপাথর, ও কোয়ার্টজ সমৃদ্ধ মাটির রং সাদা, ধূসর ও কখনো কখনো অলিভ সবুজ হয়। (4)আদি শিলায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকলে মাটি শক্ত গঠনের হয়।


[b] ভূমিরূপ (Relief) : ভূমির ঢাল, ঢালের দিক, উচ্চতা প্রভৃতির ওপর মৃত্তিকা সৃষ্টির হার নির্ভর করে – (a) সমতল ভূমিভাগে ঢালের পরিমাণ 2%-এর কম এবং এখানে সুগভীর ও সুস্পষ্ট স্তরযুক্ত মৃত্তিকা গড়ে ওঠে। (b) মধ্যম ঢালযুক্ত জমিতে (8% - 16% ) প্রতিকূল অবস্থায় স্বল্প উর্বরতা সম্পন্ন, বালুকা ও কাঁকরযুক্ত মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। (c) অত্যন্ত ঢালু জমিতে (16%-এর বেশি) অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে অগভীর মৃত্তিকা গড়ে ওঠে। যেখানে ভূমির ঢাল অত্যন্ত বেশি সেখান থেকে বিচূর্ণীকৃত শিলা সহজেই অপসারিত হয় বলে মৃত্তিকার স্তর গঠনে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং মৃত্তিকা অপরিণত বা নবীন অবস্থায় থাকে। এই প্রকার অপরিণত মৃত্তিকার সঙ্গে বড়ো বড়ো পাথর, বোল্ডার, শিলাখণ্ড প্রভৃতির সংমিশ্রণে যে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় তাকে কঙ্কালসার মৃত্তিকা বলে।


[c] সময়ের প্রভাব [Influence of time] : মৃত্তিকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার শ্লথগতি ও আদিশিলা অত্যন্ত ধীর গতিতে চূর্ণবিচূর্ণ হয় বলে জনক শিলা থেকে মাটি সৃষ্টি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্তিকা গঠনকারী প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এবং আদিশিলার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে মৃত্তিকা গঠনের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এলে তাকে পরিণত মৃত্তিকা বলে। অনুরূপে মৃত্তিকা গঠনের কাজ অসম্পূর্ণ থাকলে এবং আদিশিলার চিহ্ন যথেষ্ট মাত্রায় থেকে গেলে তাকে অপরিণত মৃত্তিকা বলে।আদিশিলার কাঠিন্যের ওপর মৃত্তিকা সৃষ্টির সময় নির্ভর করে। যেমন – কোমল শেল [shale] শিলা থেকে দ্রুত মৃত্তিকা গঠিত হয় কিন্তু অপেক্ষাকৃত কঠিন নাইস [gneiss] শিলা থেকে অত্যন্ত ধীর গতিতে মৃত্তিকা গঠিত হয়। 


আরও নোটস পেতে ক্লিক করো ⬇️

মৃত্তিকা সৃষ্টির পদ্ধতি আলোচনা করো 

মৃত্তিকা পরিলেখ এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ