Header Ads Widget

Responsive Advertisement

সামুদ্রিক প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূপসমূহ (Marine Processes and Associated Landforms)


সমুদ্রতরঙ্গের সংজ্ঞা [Definition of Wave] : প্রবল বায়ুপ্রবাহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশি একই স্থানে অবস্থান করে কেবলমাত্র ওঠা-নামা করে কিন্তু জলের কোনো স্থান পরিবর্তন ঘটে না তখন তাকে ঢেউ বা সমুদ্র-তরঙ্গ (Wave) বলে। অর্থাৎ সমুদ্র তরঙ্গ হল সমুদ্রপৃষ্ঠের কেবলমাত্র ওঠা-নামা।


সামুদ্রিক প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূপসমূহ -

A] সামুদ্রিক ক্ষয়ের ফলে গঠিত ভূমিরূপ :

সামুদ্রিক ক্ষয়কার্যের ফলে নিম্নলিখিত ভূমিরূপ গড়ে ওঠে-

1. সমুদ্রভৃগু [Sea cliff] : সমুদ্রতরঙ্গের অবিরত আঘাতের ফলে যখন উপকূলভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমুদ্রের দিকে ঝুঁকে খাড়াভাবে অবস্থান করে তখন ওই খাড়া পাড়কে সমূদ্রভৃগু বলে।

উদাহরণ : ভারতের বিশাখাপত্তনম, গোয়া প্রভৃতি স্থানে সমুদ্রভৃগু গড়ে উঠেছে।

সমুদ্র ভৃগু

2. তরঙ্গ-কর্তিত মঞ্চ [Wave-cut Platform ] : প্রবল তরঙ্গের আঘাতে উপকূলের উঁচু খাড়াা পাড় বা ভৃগু ক্ষয় পেয়ে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে। এর ফলে ভৃগুর পাদদেশ থেকে সমুদ্র জলের সমুদ্রের দিকে একটি বিস্তৃত মঞ্চ আকৃতির প্রায় সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়। একে তরঙ্গ-কর্তিত মঞ্চ বলে। 

উদাহরণ : ভারতের পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন অংশে তরঙ্গ কর্তিত মঞ্চ গড়ে উঠেছে।

তরঙ্গ কর্তিত মঞ্চ

3. সমুদ্র গুহা [Sea cave] : সমুদ্রে অভিক্ষিপ্ত বা প্রসারিত ভূমিভাগের দুদিকে ক্রমাগত সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে শিলার দারণ ও ফাটল বরাবর যে বৃহদাকার গহ্বর বা গর্তের সৃষ্টি হয় তাকে সমদ্রগুহা বলে। 

উদাহরণ : স্কটল্যান্ডের ফিঙ্গলস্ গুহা, ভারতের বিশাখাপত্তনমে সৃষ্ট গুহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সমুদ্র গুহা

4. স্বাভাবিক সমুদ্র খিলানা [Natural Sea Arch]: কোনো সংকীর্ণ ভূভাগ বা অগ্রভূমি সমুদ্রের দিকে শৈল অন্তরীপের ন্যায় এগিয়ে থাকলে, সেই এগিয়ে থাকা ভূভাগের কোমল শিলার অংশ উভয় পাশ থেকে সমুদ্রতরঙ্গের দ্বারা ক্ষয় পেতে থাকে। ফলে প্রথমে একদিকে বা উভয়দিকে গুহার সৃষ্টি হয় এবং পরে দুদিকের গুহা ভেদ করে সুড়ঙ্গের সৃষ্টি হয়। সুড়ঙ্গের উভয় পাশ উন্মুক্ত থাকে বলে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে সমুদ্রতরঙ্গ চলাচল করে এবং সুড়ঙ্গের ওপরের ছাদটি খিলানের মত অবস্থান করে। এই প্রকার খিলানকে আর্চ [arch] বলে। একে প্রাকৃতিক খিলান-ও বলা হয়।

উদাহরণ: অস্ট্রেলিয়ার ডেভন, টরক প্রভৃতি অঞ্চলে খিলান গড়ে উঠেছে।


5. ব্লো- হোল [blow-hole] : সমুদ্রভৃগুতে দুর্বল শিলা অবস্থান করলে সেখানে প্রথমে একটি গুহার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি তরঙ্গের আঘাতে গুহার অভ্যন্তরস্থ বায়ু শিলাগাত্রে চাপ দেয়। ফলে শিলাগাত্র ক্রমশ শিথিল হয় এবং গুহাটি ধীরে ধীরে অভ্যন্তরের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। হালকা বলে বায়ুর চাপ উপরের দিকে পড়ে শিলাখণ্ড ধসে যায় এবং গুহাটি ক্রমে ক্রমে ভূপৃষ্ঠে এসে উন্মুক্ত হয়। সমুদ্রে-উন্মুক্ত-গুহামুখে তরঙ্গ এসে আঘাত করলে সেই জল ভূপৃষ্ঠে-উন্মুক্ত গুহামুখে বায়ুর সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে আসে। ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত এই গুহামুখকে ব্লো-হোল বা ফোয়ারা গর্ত বা গহ্বর বা গ্লুপ বা স্পাউটিং হর্ন বা স্বাভাবিক চিমনি বলে।

উদাহরণ : অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ ব্লো হোল লক্ষ করা যায়।

ব্লো হোল

6. জিও [Geo] : ক্রমাগত সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে একসময় সমুদ্রগৃহার ছাদ ধসে পড়ে এবং এক দীর্ঘ ও সংকীর্ণ প্রবেশ পথের সৃষ্টি হয়। একে স্কটল্যান্ডে এবং ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জে ‘জিও' বলা হয়।

উদাহরণ : অস্ট্রেলিয়ার জার্ভিস উপসাগরের উপকূলে এবং স্কটল্যান্ডের উপকলে জিও গড়ে উঠেছে।

জিও

7. সামুদ্রিক স্তম্ভ বা স্ট্যাক [Sea Pillar or Stack] : প্রবল সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে একসময় সমুদ্র খিলানের ওপরের অংশ বা ছাদ ধসে পড়ে এবং কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত অংশ অগভীর সমুদ্রে সমুদ্রতলের ওপরে থাম বা স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রকার স্তম্ভকে সামুদ্রিক স্তম্ভ বা স্ট্যাক বলে। একে স্ক্যারি ও বলে, একে চিমনি ও বলে। 

উদাহরণ : স্ট্যাকের অন্যতম সুন্দর নিদর্শন হল ওর্কনি দ্বীপের ‘Old man of Hoy'।

স্ট্যাক

8. স্টাম্প [Stump] : স্টাক সামুদ্রিক ক্ষয় কার্যের দ্বারা প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নেমে এলে, তাকে স্টাম্প বলে।


9. কোভ, বাইট ও উপসাগর [Cove, Bight and Bay] : কোমল শিলা দ্বারা গঠিত উপকূলভাগ সমুদ্র তরঙ্গআবহবিকার দ্বারা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যদি উত্তল বৃত্তচাপীয় খাঁড়ি গঠন করে তখন তাকে কোভ, অল্প বক্তৃতাযুক্ত দীর্ঘায়িত বাইট এবং অধিক বক্তৃতার কারণে গঠিত তিনদিক স্থল দ্বারা বেষ্টিত অগভীর সমুদ্রকে উপসাগর বলে।


10. অগ্রভূমি [Headland]: উপকূলরেখার পশ্চাদপসরণে যদি সমুদ্রভৃগুর অধিকতর ক্ষয় প্রতিরোধকারী কঠিন শিলা তটভূমি থেকে সমুদ্রের দিকে অভিক্ষিপ্ত থাকে তবে তাকে অগ্রভূমি বলে।

উদাহরণ : ভারতের পূর্ব উপকূলের অন্ধ্র উপকূলে ওয়ালটেয়ারের ডলফিন নোজ হল এই প্রকার অগ্রভূমি।



B] সামুদ্রিক অবক্ষেপণের ফলে গঠিত ভূমিরূপ :

1. সৈকত বা বেলাভূমি [Beach] : সমুদ্র-তরঙ্গের দ্বারা বাহিত বিভিন্ন আকারের শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি তটভূমির উপর সঞ্চিত হয়ে সমুদ্রের দিকে যে ঈষৎ ঢালু প্রায় সমতল ভূমি গড়ে ওঠে তাকে সৈকত ভূমি বা বেলাভূমি বলে।

উদাহরণ : ভারতের কোঙ্কন উপকূল, দিঘা উপকূলের সৈকত বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সৈকত

2. সামুদ্রিক বাঁধ [Bar] : অনেক সময় উপকূল থেকে কিছু দূরে প্রভৃতি উপকূল রেখার সমান্তরালে সঞ্চিত হয়ে যে সংকীর্ণ ও দীর্ঘায়িত স্তূপ গড়ে ওঠে তাকে সামুদ্রিক বাঁধ বা চরবাঁধ বলে।

উদাহরণ : ভারতের পূর্ব উপকূলে এই ধরনের বাঁধ গড়ে উঠেছে।   

প্রকারভেদ : প্রকৃতি ও গঠন অনুসারে সামুদ্রিক বাঁধ তিন প্রকারের হয়। যথা—  

 a)পুরোদেশীয় বাঁধ (Offshore Bar) : উপকূলের প্রায় সমান্তরালে কোনো নদীর মোহনায় আড়াআড়িভাবে কিংবা প্রধান ভূমিভাগ ও নিকটবর্তী কোনো দ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অথবা উপকূল যেখানে বেঁকে দিক পরিবর্তন করেছে সেখানে সামুদ্রিক সঞ্চয়জনিত যে বাঁধের সৃষ্টি হয় তাকে পুরোদেশীয় বাঁধ বলে।

উদাহরণ : ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের নরফোক উপকূলে, ভারতের কেরল উপকূলে অনেক পুরোদেশীয় বাঁধ দেখা যায়।

b)অনুতটীয় বাঁধ [Longshore Bar] : উপকূল থেকে বেশ কিছু দূরে বেলাভূমির ওপর স্রোতের দ্বারা বাহিত সঞ্চিত হয়ে যে বালির বাঁধ গঠিত হয় তাকে অনুতটীয় বাঁধ বলে।

c)প্রতিবন্ধক সৈকত বা দ্বীপ [Barrier Beach or Island] : পুরোদেশীয় বেলাভূমিকে বেষ্টন করে সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর স্থায়ীভাবে অবস্থান করলে তাকে প্রতিবন্ধক সৈকত বা বেলাভূমি বলে। এবং তটরেখার সমান্তরালে পুরোদেশীয় বাঁধ দ্বারা বেষ্টনকারী দ্বীপকে প্রতিবন্ধক দ্বীপ বলে।

পুরোদেশীয় বাঁধ

3. স্পিট [Spit] : স্পিট হল এমন একটি চরবাঁধ যার এক প্রান্ত স্থলভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং অপরটির প্রান্ত উন্মুক্ত সমুদ্রে শেষ হয়ণ। স্পিট স্থলভাগ থেকে শুরু হয়ে সমুদ্রের দিকে শেষ হয়। 

উদাহরণ : ভারতের পূর্ব উপকূলে চিল্কা হ্রদের মুখে 50 কিমি দীর্ঘ স্পিট দেখা যায়।

স্পিটের প্রকারভেদ : স্পিট দু’প্রকারের হয়ে থাকে। এরা হল– 

(i) হুক স্পিট বা বক্রাকার স্পিট [Hook Spit or Curved Spit] : যে উপকূল অঞ্চলে স্থলাভিমুখী সমুদ্র স্তর বা শক্তিশালী জোয়ারের প্রাবল্য বেশি থাকে সেখানে স্পিট স্থলভাগের দিকে বেঁকে গিয়ে যদি হুকের বা কাস্তের ফলার মতো বা বঁড়শির মতো আকার ধারণ করে তখন তাকে হুক বা বক্রাকার স্পিট বলে।

(ii) ঘূর্ণন স্পিট [Spiral Spit] : সমুদ্র তরঙ্গের বার বার দিক পরিবর্তনের ফলে স্পিট চক্রাকারে বা ঘূর্ণির আকারে গড়ে উঠলে তাকে ঘূর্ণন স্পিট বলে।

স্পিট

4. কাস্পেট বাঁধ [Cuspate bar] : দুটি সমুদ্রাভিমুখী কার্ভড স্পিট বা বক্রাকার স্পিট সমুদ্রে একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে ত্রিকোণাকার ভূমিরূপ বা অন্তরীপ গঠন করে তাকে কাস্পেট বাঁধ বা তীক্ষ্ণগ্রবাঁধ বলে।


5. টম্বোলো [Tombolo] : এটি একধরনের চরবাঁধ। যখন কোনো চরবাঁধের দ্বারা একটি দ্বীপ মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় কিংবা একটি দ্বীপ অপর একটি দ্বীপের সঙ্গে চরবাঁধের দ্বারা যুক্ত হয় তখন সেই সংযোগকারী চরবাধকে টম্বোলো বলে। 

উদাহরণ : ইংল্যান্ডের ডর্সের্ট উপকূলের 25 কিমি দীর্ঘ চেসিল বীচ নামক টম্বোলোটি পোর্টল্যান্ড দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

টম্বোলো

6. বে-বার [Bay-bar] : উপসাগরের সম্মুখে স্পিট বেড়ে গিয়ে যে বাঁধ গড়ে ওঠে তাকে বে-বার বলে। যেমন দক্ষিণ কর্ণওয়েলের বে বার। এখানে Bay বা বে মানে উপসাগর এবং bar বা বার মানে বাঁধ।


7. লুপ-বার [Loop-bar] : দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে যখন স্পিট বাড়তে বাড়তে বেশ খানিকটা ঘুরে অর্থাৎ অর্ধগোলাকারে প্রধান ভূখণ্ডের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় তখন তাকে লুপ-বার বলে। যেমন- সামকা দ্বীপকে বেষ্টন করে লুপ-বার গঠিত হয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কেনেডি ও ফ্লোরিডা অঞ্চলে এই প্রকার ভূমিরূপ দেখা যায়। 


8. উপকূলীয় বালিয়াড়ি [Coastal Dune]] : উপকূল অঞ্চলের প্রবল বায়ুপ্রবাহের কারণে সমুদ্রসৈকতের বালি উড়ে গিয়ে উপকূলভাগে স্তূপাকারে সঞ্চিত হলে তাকে উপকূলীয় বালিয়াড়ি বা ডেন [den] বলে। দীঘা ও ওড়িশা উপকূলে এধরনের অনেক বালিয়াড়ি দেখা যায়।


9. লেগুন বা উপহ্রদ (Lagoon) : কোনো সমুদ্র বাঁধের বিস্তারের ফলে উপসাগরের মুখ আবদ্ধ হয়ে যায় এবং বাঁধ উঁচুতে ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী অংশে সমুদ্র জল জমা হয়ে সৃষ্ট লবণাক্ত জলাভূমি লেগুন বা উপহ্রদ নামে পরিচিত। যেমন— ভারতের চিল্কা বৃহত্তম লেগুনের উদাহরণ।


10. কর্দমাক্ত সমভূমি [Mud flats] : যে সব বেলাভূমিতে বালুকারাশির পরিবর্তে পলি ও কাদা সঞ্চিত হয়ে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাদের কর্দমাক্ত সমভূমি বা সাবখা বলে। সমুদ্র তরঙ্গের সঞ্চয়কার্যের সঙ্গে যখন নদীর সঞ্চয়জনিত পদার্থসমূহ সৈকতভূমিতে সঞ্চিত হয় তখন এই প্রকার সমভূমির সৃষ্টি হয়। হল্যান্ডের পোল্ডার অঞ্চল এই প্রকার সমভূমির উদাহরণ।


11. লবণাক্ত সমভূমি [Salt flat] : বিভিন্ন প্রকার বাঁধ ও উপকূলের মধ্যে অনেক সময় সমুদ্রের জল আবদ্ধ হয়ে লবণাক্ত জলাভূমি বা লেগুন বা উপহ্রদের সৃষ্টি হয়। এতে লবণের আস্তরণ দেখা যায় বলে একে লবণাক্ত সমভূমি বলে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ