Header Ads Widget

Responsive Advertisement

জনসংখ্যা ও সম্পদ ( Population and Resource)

                     জনসংখ্যা ও সম্পদ
         ( Population and Resource)


সম্পদ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য মানুষ। মানুষ ছাড়া সম্পদ সৃষ্টি মূল্যহীন। সেজন্য সম্পদ সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হল মানুষ। মানুষের জন্যই কোনো বস্তু বা উপাদান সম্পদ পদবাচ্য হয়। এজন্যই বলা হয় “Resource of the man, by the man and for the man.


জনসংখ্যা [Population]

অর্থ : ইংরাজি 'Population' (পপুলেশন) শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল 'জনসংখ্যা'। এই জনসংখ্যা শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন—(i) বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে জনসংখ্যা বলতে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই প্রজাতিভুক্ত সমস্ত জীবের একত্রিত সমাবেশ বোঝায়। যেমন—সুন্দরবনে মোট বাঘের সংখ্যাকে টাইগার পপুলেশন বলে। সুতরাং পপুলেশন বলতে কেবলমাত্র মানুষের সংখ্যাকেই নির্দেশ করে না। (ii) পরিসংখ্যান শাস্ত্রে কোনো কিছুর সংখ্যা বোঝাতে পপুলেশন শব্দটি ব্যবহৃত হয় এবং সেটি গাছপালা, পশুপাখি, বাড়িঘর এমনকি গাণিতিক সংখ্যাও হতে পারে। (iii) ভূগোলে পপুলেশন বা জনসংখ্যা বলতে ব্যাপক অর্থে মানুষের সংখ্যাকেই বোঝায়।

সংজ্ঞা: ভূগোল শাস্ত্রে জনসংখ্যা হল মানুষ বা হোমো সেপিয়ানস্-এর মোট সংখ্যা। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী এবং একই কর্মপরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টিকে ওই নির্দিষ্ট এলাকার নির্দিষ্ট সময়ের জনসংখ্যা বলে।

বৈশিষ্ট্য : (i) জনসংখ্যা সর্বদা পরিবর্তনশীল, পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটে। (ii) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হাল সব বছর সমান নয়। (iii) অধিকাংশ দেশেই জনসংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। (iv) পৃথিবীর সব জায়গায় জনসংখ্যার বণ্টন সমান নয়। (v) জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার সব দেশে সমান নয়।


জনসংখ্যা এবং সম্পদ সম্পর্ক (Population and Resource Relation) :

কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ অর্থাৎ জনসংখ্যার সঙ্গে ওই অঞ্চলে প্রাপ্ত সম্পদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জনসংখ্যা ও সম্পদের সম্পর্ক খাদ্যবস্তু ও অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদনের মাত্রাও সেখানকার মানুষের জীবনধারায় লক্ষ্য করা যায়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির হার নির্ধারিত হয় সেখানকার জনসংখ্যা ও সম্পদের অন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে।

এই জনসংখ্যা ও সম্পদের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তিনটি ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। যা নিম্নরূপ—

1. কাম্য জনসংখ্যা (Optimum Population) 

2. জনাধিক্য বা অতিজনসংখ্যা বা জনাকীর্ণতা (Over Population) 

3. জনস্বল্পতা বা অল্পজনসংখ্যা (Under Population)


1 ] কাম্য জনসংখ্যা বা আদর্শ জনসংখ্যা [Optimum Population]

সংজ্ঞা : সাধারণভাবে কোন দেশে প্রাপ্ত সম্পদের উপযুক্ত ও পরিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে যে পরিমাণ জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মানের চরমতম ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়, সেই পরিমাণ জনসংখ্যাকে কাম্য বা আদর্শ জনসংখ্যা বলে। অধ্যাপক জিমারম্যান-এর ভাষায়, মানুষ-জমি অনুপাতের আদর্শ অবস্থাকেই সাধারণভাবে কাম্য জনসংখ্যা বলে। সুতরাং বলা যায়, মানুষ-জমির আদর্শ অনুপাতই হল কাম্য জনসংখ্যা। আবার অন্যভাবে বলা যায়, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সর্বাপেক্ষা অনুকূল জনসংখ্যাই হল কাম্য জনসংখ্যা।

কে. উইকসেল [K. Wickcell] সর্বপ্রথম ‘কাম্য জনসংখ্যা' শব্দটি ব্যবহার করেন।


 কাম্য জনসংখ্যা নির্ণয়ের সূত্র : প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং মানুষের কর্মদক্ষতার একটি আদর্শ অনুপাতই হল কাম্য জনসংখ্যা। অর্থাৎ

কাম্য জনসংখ্যা=

মোট জনসংখ্যা + তাদের কর্মদক্ষতা + সংস্কৃতি / 

মোট কার্যকর জমির ক্ষেত্রফল × জমির বহন ক্ষমতা


কাম্য জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Optimum Population) : কাম্য জনসংখ্যা হল কোনো দেশের মোট জনসংখ্যা ও কার্যকরী জমির অনুপাত। কাম্য জন সংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ 

• কাম্য জনসংখ্যার ধারণাটি হল একটি গতিশীল ধারণা। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যা বা সম্পদ কোনো একটির পরিবর্তন হলে কাম্য জনসংখ্যাও পরিবর্তন হয়।

• কাম্য জন সংখ্যা হলো মানুষ-জমি অনুপাতের আদর্শ অবস্থা। অর্থাৎ মোট কার্যকরী জমি ও জনসংখ্যার মধ্যে একটা সমতা বিরাজ করে।

• কোনো দেশের জনসংখ্যা কাম্য ভাবে বিরাজ করলে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় ।

• কাম্য জনসংখ্যার ফলে দেশের সম্ভাব্য সম্পদ জনসাধারনের ভোগ সুখের ব্যবস্থার উপযোগী হয়।

• কাম্য জনসংখ্যায় মানুষ ও জমির মধ্যে গুণগত সম্পর্ক দেখানো হয়। 

• জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সম্পদ উৎপাদন বৃদ্ধির চূড়ান্ত লক্ষ্যের একটি স্থিতিশীল অবস্থা হল কাম্য জনসংখ্যা।

• কাম্য জনসংখ্যার ফলে সম্পদ উৎপাদনে প্রয়োজনীয়, শ্রমশক্তির অভাব হয় না। যার ফলে সম্পদ উৎপাদন সর্বাধিক হয়। 

• কাম্য জনসংখ্যার ফলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।

• কাম্য জনসংখ্যার ফলে দেশে জনসংখ্যা ও সম্পদের মধ্যে সাম্যতা থাকায় বেকারত্ব থাকে না।

•সম্পদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। 

 

2 ] জনাকীর্ণতা বা জনাধিক্য বা অতি প্রজতা [Over Population]:

সংজ্ঞা : কোনো দেশের জনসংখ্যা সম্পদের তুলনায় বেশি হলে তাকে জনাকীর্ণতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো অঞ্চলের বা দেশের জনসংখ্যা যখন কাম্য জনসংখ্যার থেকে বেশি হয়, তখন তাকে জনাধিক্য বা জনাকীর্ণতা বলে। 

উদাহরণ : ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি হল জনাধিক্যসম্পন্ন দেশ।

বৈশিষ্ট্য : (i) মানুষ-জমি অনুপাত কাম্য জনসংখ্যা অপেক্ষা বেশি। (ii) কার্যকর জমির উপর চাপ বাড়ে। (iii) জমি অধিক ব্যবহার হয়, ফলে জুমির অবক্ষয় হয়। (ix) মাথাপিছু সম্পদ প্রাপ্তি হ্রাস পায়, ফলে আয় কম হয়। (vi) শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত হওয়ার ফলে দ্রুত বেকারত্বের সৃষ্টি হয়।


3 ] জনস্বল্পতা বা জনবিরলতা [Under Population] 

সংজ্ঞা : কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম হলে তাকে জনস্বল্পতা বা জনবিরলতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো অঞ্চলে বা দেশের জনসংখ্যা যখন কাম্য জনসংখ্যার চেয়ে কম হয় তখন তাকে জনস্বল্পতা বলে। অর্থাৎ জনসংখ্যার তুলনায় কার্যকরী জমির পরিমাণ বেশি হলে জনবিরলতার সৃষ্টি হয়। 

উদাহরণ : অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে জনস্বল্পতা লক্ষ করা যায়। 

বৈশিষ্ট্য : (i) দেশের মোট উৎপাদিত সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যার পরিমাণ কম হয়। ii) জনস্বল্পতার কারণে মাথাপিছু সম্পদের উৎপাদন বাড়লেও মোট সম্পদের উৎপাদন বাড়ে না। (ii) কৃষি ও শিল্প অনুন্নত ও জনপ্রতি আয় কম হয়। (iv) সম্পদ উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি খুবই মন্থর গতিতে হয়। (v) দেশের আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটে না।


মানুষ-জমি অনুপাত (Man-Land Ratio) :

সংজ্ঞা : কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যাকে সেই দেশের মোট কার্যকরী জমির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যায় তাকে মানুষ-জমি অনুপাত মান বলে। মানুষ-জমি অনুপাত বলতে দেশের মোট জনসংখ্যা এবং দেশের মোট কার্যকরী জমির অনুপাতকে বোঝায়।

নির্ণয় পদ্ধতি : কোনো অঞ্চল বা দেশের সংস্কৃতি সম্পন্ন মোট জনসংখ্যাকে অঞ্চল বা দেশটির উৎপাদনশীল কার্যকর জমির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে মানুষ-জমি অনুপাত নির্ণয় করা হয়।

মানুষ-জমি অনুপাত =

দেশ বা অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পন্ন মোট জনসংখ্যা /

এই দেশ বা অঞ্চলের উৎপাদনশীল মোট কার্যকর জমির ক্ষেত্রমান 


মানুষ জমি অনুপাতের প্রভাব (Impact of Man land Ratio) :

1) নিবিড় কৃষি প্রচলন : কোনো দেশে মানুষ-জমি অনুপাত বেশি হলে অর্থাৎ জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমান কম হলে সেই সমস্ত দেশে নিবিড় কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এই কৃষি পদ্ধতিতে উন্নত বীজ, কীটনাশকসার, জলসেচ, কৃষিজ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় বলে হেক্টর প্রতি উৎপাদন বেশি হয়। কিন্তু মাথাপিছু উৎপাদন কম হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারত, জাপান, চীন, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে এই পদ্ধতিতে চাষ করা হয়।

2) ব্যাপক কৃষির প্রচলন : কোনো দেশে মানুষ-জমি অনুপাত কম হলে অর্থাৎ জনসংখার তুলনায় জমির পরিমান বেশি হলে সেই সমস্ত দেশে ব্যাপক কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। উন্নত পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করা হয় বলে মাথাপিছু উৎপাদন বেশি হয়। কিন্তু হেক্টর প্রতি উৎপাদন কম হয়। কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এই কৃষি লক্ষ্য করা যায়।

3) দেশান্তরের প্রবণতা : কোনো দেশের মানুষ জমি অনুপাত কম হলে কার্যকারী জমির সন্ধানে মানুষ সেই স্থান ত্যাগ করে। অতীতে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে লোক বসতির তুলনায় কার্যকরী জমির পরিমান বেশি ছিল। তাই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের লোকেরা সেই সমস্ত দেশে বসতি স্থাপন করেন।

4) চাহিদা ও যোগানের বৈশিষ্ট্য : নিবিড় কৃষি পদ্ধতিতে কার্যকর জমির উপর ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বাড়ে। জমিতে অধিক মলূধন নিয়োগ করলেও উৎপাদন সেই হারে বড়ে না। এর ফলে চাহিদা ও যোগানের বৈষম্য দেখা যায়, কৃষিতে ছদ্ম বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ে। রপ্তানি নির্ভর কৃষি আমদানি নির্ভর কৃষিতে পরিণত হয়।

5) জমির বহন ক্ষমতা : কোনো দেশে মোট জমি বা সম্পদের কার্যকরী অংশ যখন ওই দেশের সর্বাধিক মানুষের অভাব দূর করে, তখন ওই নির্দিষ্ট জমি বা সম্পদের কার্যকর পরিমানকে জমির বহন ক্ষমতা বলে। এই বহন ক্ষমতা প্রযুক্তি, জমিতে সারের ব্যবহার, ভূমির উপর চাপ, জমি সম্পর্কিত পরিকল্পনা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ