আধুনিক যুগে বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্যে মহাসাগরের তলদেশের ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করা হয়েছে । সমুদ্রবিজ্ঞানী স্যার জন মারে হিপসোমেট্রিক লেখচিত্রের সাহায্যে সমুদ্র তলদেশের গভীরতা নির্ণয়ের সময় সমুদ্র তলদেশের চারটি প্রধান ভাগের উল্লেখ করেন মহিসোপান, মহিঢাল, ও গভীর সমুদ্রের সমভূমি ও সামুদ্রিক খাত।
1)মহিসোপান (Continental Shelf)
সংজ্ঞা : তটরেখা থেকে সমুদ্রে 100 ফ্যাদম বা 200 মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ও গড়ে 1° বা তার থেকে কম মানের ঢালযুক্ত নিমজ্জিত অংশকে মহিসোপান বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য :
• মহিসোপান ক্রমশ ঢালু হয়ে স্থলভূমি থেকে গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়।
• মহিসোপান সিয়াল (SIAL) দ্বারা গঠিত মহাদেশের প্রান্তীয় অঞ্চল।
• মহিসোপানের গড় বিস্তার থাকে সাধারণত 78 কিমি, তবে প্রায় 1510 কিমি বিস্তৃত মহিসোপানের সন্ধানও পাওয়া গেছে।
• উপকূলীয় অঞ্চল তরঙ্গায়িত প্রকৃতির হলে মহিসোপানের বিস্তার কম হয়ে থাকে, কিন্তু নীচু সমভূমির বৈশিষ্ট্য সমন্বিত উপকূলে এর বিস্তার অনেক বেশি।
• মহিসোপানে খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও মাছের খাদ্য প্ল্যাংকটন পাওয়া যায়।
• মহিসোপানে প্রবাল প্রাচীর ও প্রবালদ্বীপ লক্ষ করা যায়।
2)মহিঢাল (Continental Slope)
সংজ্ঞা : মহিসোপানের পরবর্তী যে অঞ্চল খাড়া ঢাল গঠন করে গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে গভীর সমুদ্রের সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তাকে মহিঢাল বলে।
বৈশিষ্ট্য:
• সমুদ্রগর্ভের প্রায় 180-3600 মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহিঢালের বিস্তার।
• এই অশের ঢালের মান 2° 15° পর্যন্ত হয়ে থাকে।
• এই অঞ্চল গড়ে 16-32 কিমি পর্যন্ত প্রশস্ত।
• মহিসোপানের প্রান্তভাগ থেকে মহিঢালের সূচনা ঘটে।
• মহিচালের উপরিভাগ সিয়াল (SIAL) দ্বারা গঠিত হলেও এক্ষেত্রে মহাসাগরীয় শিলা (SIMA)-র আধিক্যই লক্ষ করা যায়।
• মহিঢালের ঢালের মান খুব বেশি হওয়ায় স্থলজাত পদার্থ সঞ্চিত হতে পারে না।
3)গভীর সমুদ্রের সমভূমি (Deep Sea Plain/Abyssal Plain)
সংজ্ঞা ঃ সমুদ্র তলদেশে মহিঢাল শেষ হওয়ার পরে যে বিশালায়তন সমতল ভূমিভাগ গড়ে উঠে তাকে গভীর সমুদ্রের সমভূমি বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য :
• এই অঞ্চলটি সাগর-মহাসাগরের গভীরতম, ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমতল প্রকৃতির অংশ।
• বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রতলের প্রায় 50% অংশ জুড়ে এই সমভূমি অবস্থিত।
• এই সমভূমিতে_ শৈলশিরা, সমুদ্রগিরি, গায়ট প্রভৃতির সন্ধান পাওয়া যায়।
• এই অঞ্চলে অবক্ষেপিত পদার্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সিন্ধুকর্দ।
• এই সমভূমি অঞ্চল 3500-5500 মিটারের অধিক গভীর।
4)গভীর সামুদ্রিক খাত (Deep Oceanic Trench)
সংজ্ঞা : গভীর সমুদ্রের সমভূমির মাঝে মাঝে সৃষ্ট দীর্ঘ, সংকীর্ণ ও সুগভীর যে খাতগুলি গড়ে ওঠে তাদের গভীর সামুদ্রিক খাত বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য :
• সমুদ্রখাতের গড় গভীরতা প্রায় 7 কিমি।
• সমুদ্রখাতের দুই প্রান্তের ঢাল বেশ খাড়া।
• ও এখানে জলের চাপ অধিক এবং এর নিম্নভাগ ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন।
• সমুদ্রখাতগুলিকে পরিখা খাত বা সুদীর্ঘ সমুদ্রখাত (Trench) বলা হয়, কারণ এদের দৈর্ঘ্য 1000 কিমি বা তার অধিক হয়, তবে গড় প্রস্থের মান 100 মিটার।
• সাগর-মহাসাগরের পাতসীমান্ত বরাবর সাধারণত এই খাতগুলি গড়ে ওঠে।
প্রধান চার প্রকার ভূমিরূপ ছাড়া সমুদ্র তলদেশে আরও যেসব ভূমিরূপগত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—সামুদ্রিক ক্যানিয়ন, সামুদ্রিক শৈলশিরা, গভীর সামুদ্রিক পাহাড়, মহাদেশীয় ক্রমোচ্চ ভূমিভাগ, আগ্নেয়গিরি, মালভূমি, টিলা প্রভৃতি।
5)সামুদ্রিক ক্যানিয়ন (Submarine Canyon)
সংজ্ঞা : সমুদ্রগর্ভে মহিঢালের প্রান্তভাগে অসংখ্য শাখাপ্রশাখা সমন্বিত ইংরেজি 'V' বা 'I’ আকৃতির যে উপত্য গড়ে ওঠে তাকে সামুদ্রিক বা অন্তঃসাগরীয় ক্যানিয়ন বা গিরিখাত বলে।
বৈশিষ্ট্য:
• সমুদ্রতল থেকে প্রায় 2 কিমি গভীরতায় এই ক্যানিয়ন গড়ে ওঠে।
• এই ক্যানিয়নের ঢালের মান প্রায় 5°-70 হয়।
• গঠনের সময়কালের দিক থেকে যথেষ্ট নবীন এই ক্যানিয়নগুলি ভূমির সঙ্গে প্রায় উল্লম্বভাবে অবস্থান করে।
• মহিসোপান ও মহিঢাল অঞ্চলে গঠিত হয়ে এগুলি গভীর সমুদ্রের সমভূমি পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
6)গভীর সামুদ্রিক পাহাড় (Abyssal Hill)
সংজ্ঞা : গভীর সমুদ্রের সমভূমি মধ্যস্থ বিভিন্ন ফাটল বরাবর ভূগর্ভস্থ আগ্নেয় পদার্থ নির্গমনের ফলে যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা গড়ে ওঠে, তাকে গভার সামুদ্রিক পাহাড় বলে।
বৈশিষ্ট্য :
• গভীর সামুদ্রিক পাহাড়গুলি আগ্নেয় পদার্থ জয়ের ফলে গড়ে ওঠায় এদের অপর নাম আগ্নেয় পর্বত।
• সমুদ্র তলদেশের প্রায় 30% অঞ্চলব্যাপী এদের অবস্থান করা যায়।
• এগুলি সাধারণত বিচ্ছিন্ন গম্বুজের মতো অবস্থান করে।
• এদের বিস্তার প্রায় 0.1-100 কিমি এবং চতা সমুদ্রগর্ভ থেকে প্রায় 1000 মিটার বা তার অধিক হয়ে থাকে।
7)সামুদ্রিক শৈলশিরা (Oceanic Ridge)
সংজ্ঞা : গভীর সামুদ্রিক সমভূমির মাঝে বিভিন্ন স্থানে যে সুদীর্ঘ শৈলশিরা গড়ে ওঠে তাকে সামুদ্রিক বা মহাসাগরীয় শৈলশিরা বলে।
বৈশিষ্ট্য :
• বৃহদাকৃতির সামুদ্রিক শৈলশিরাগুলি দৈর্ঘ্যে প্রায় 4000-6000 কিমি এবং প্রস্থে কয়েক শত কিমি হয়ে থাকে।
• এই শৈলশিরাগুলি সাধারণত অপসারী বা প্রতিসারী পাত সীমান্ত বরাবর গড়ে ওঠে এবং এই স্থানে ছিন্ন চ্যুতি সৃষ্টি হয়।
• এই শৈলশিরা বরাবর অগ্ন্যুৎপাত হয়। এখানে উয়তা তুলনামূলকভাবে অধিক।
0 মন্তব্যসমূহ