Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ভারতের জলবায়ু (Climate of India) | ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকসমুহ (Controlling Factors of Indian Climate)

        ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকসমুহ 

     (Controlling Factors of Indian                Climate)


সুবিশাল দেশ এই ভারতবর্ষ। ভারতের উপদ্বীপীয় অবস্থান অর্থাৎ, তিনদিক বেষ্টিত সমুদ্র, হিমালয়, পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অবস্থান। উপদ্বীপীয় মালভূমির বিস্তৃতি জলবায়ুকে অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।ভারতীয় জলবায়ুর এরূপ বৈচিত্র্যের নিয়ন্ত্রকগুলি হলো—

1. অবস্থান ও অক্ষাংশগত বিস্তৃতি : ভারতের দক্ষিণাংশটি উপদ্বীপীয়। দু-দিকে ভারত মহাসাগরের দুটি প্রসারিত অংশ—আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর। উত্তরদিকে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সুউচ্চ পর্বতমালা অবস্থিত। ভারতের দক্ষিণ থেকে উত্তরে অক্ষাংশগত ব্যবধান বেশি, দক্ষিণে 8°04′ দক্ষিণ থেকে উত্তরে 37°06′ উত্তর সমাক্ষরেখা পর্যন্ত ভারত বিস্তৃত। ফলে দক্ষিণে লম্ব সূর্যকিরণের (92°–85° কোণে) জন্য নিরক্ষীয় এবং উত্তরে কিছুটা হেলানো (67°-70° কোণে) সূর্যকিরণের জন্য নাতিশীতোয় প্রকৃতির জলবায়ু দেখা যায়।

2. হিমালয় পর্বতের অবস্থান : ভারতের উত্তর দিকে প্রাচীরের মতো সুউচ্চ হিমালয় পর্বত অবস্থান করছে। এই পর্বত থাকায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, অন্যদিকে উত্তর দিকের শীতল সাইবেরীয় বাতাস ভারতে প্রবেশ করতে বাধা পায়। ফলে, ভারতে শীতের প্রকোপ কম হয়।

3. ভূপ্রকৃতির ভূমিকা: ভারতে পর্বত, মালভূমি, সমভূমি সকল প্রকার ভূপ্রকৃতিই দেখা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যে স্থান যত উচ্চতায় অবস্থিত তার উষ্ণতা ততই কমতে থাকে। তাই ভারতের পার্বত্য অঞ্চলগুলির উষ্ণতা সমভূমি অঞ্চল থেকে কম হয়। যেমন—গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল থেকে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের উন্নতা কম হয়।

4. সমুদ্র সান্নিধ্যের প্রভাব: সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল সমুদ্র বায়ু ও স্থলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রভাব সমুদ্র থেকে 150-200 কিমি পর্যন্ত থাকে। ফলে সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন হয়। অন্যদিকে সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে সমুদ্র ও স্থলবায়ুর প্রভাব নেই বলে জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হয়। তাই মুম্বাই, গোয়া, কোচিন প্রভৃতি স্থানগুলি উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত বলে শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা কম। অন্যদিকে দূরে অবস্থানের জন্য পাটনা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে শীত ও গ্রীষ্ম উভয়েরই তীব্রতা বেশি।

5. মৌসুমি বায়ুরপ্রভাব : ভারতের জলবায়ুর ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সর্বাধিক। তাই ভারতবর্ষকে ‘মৌসুমি জলবায়ুর দেশ বলা হয়। এখানে গ্রীষ্মকালে সমুদ্র থেকে আগত জলীয় বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে, শীতকালে স্থলভাগ থেকে আগত শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয় না, কারণ এতে জলীয় বাষ্প থাকে না। তবে এই বায়ু বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে এসে করমণ্ডল উপকূলে শীতকালে বৃষ্টিপাত ঘটায়।

6. জেটবায়ুর প্রভাব : এই জেট বায়ুপ্রবাহ ভারতের মৌসুমি বায়ু ও জলবায়ুকে প্রভাবিত করে।  গ্রীষ্মকালে ভারতের ওপর অবস্থানকারী উপক্রান্তীয় জেটবায়ু উত্তরে সরে যায়। আর তখনই ভারতে ক্রান্তীয় পুবালি বায়ুর আগমন ঘটে ও এর সঙ্গে মৌসুমি বায়ু আসে। ফলে ভারতে প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শীতকালে ভারত উপমহাদেশ অঞ্চলে উপক্রান্তীয় পশ্চিমি জেটবায়ু অবস্থানের কারণে এখানে উচ্চচাপ বিরাজ করে, ফলে উপমহাদেশ থেকে মৌসুমি বায়ু প্রত্যাগমন করে। অর্থাৎ মৌসুমি বায়ু আগমন ও প্রত্যাগমনের সঙ্গে জেটবায়ু আন্তঃসম্পর্কযুক্ত।

7. ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের প্রভাব : ভারতের দক্ষিণে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত ভারতের বিশেষত দক্ষিণ ভারতের জলবায়ুকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনের সময় অর্থাৎ, গ্রীষ্মকালে এবং প্রত্যাবর্তনের সময় অর্থাৎ, শরৎকালে সমুদ্রের ওপর সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে ঘূর্ণবাত বা সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণবাত আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে অধিক সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে ভারতের উপকূল অঞ্চলে তীব্র বৃষ্টি হয় এবং উন্নতা কিছুটা হ্রাস পায়।

8. পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাব : ভারতে শীতকালের শান্ত আবহাওয়ার মধ্যে ভূমধ্যসাগর থেকে আসা পশ্চিমা বায়ু বায়বীয় গোলযোগ সৃষ্টি করে, যা পশ্চিমি ঝঞ্ঝা নামে পরিচিত। এর প্রভাবে দু-চারদিন একটানা আকাশ মেঘলা থাকে ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত ঘটে। এই বৃষ্টি ও তুষারপাত ভারতে শীতের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেয়।

9. এল নিনোর প্রভাব : দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু ও চিলি উপকূলে এক অস্থির ও অনির্দিষ্ট উষু সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, একে এল নিনো বলে। এল নিনোর অর্থ ‘দুরন্ত বালক’ বা ‘জিশু খ্রিস্ট’ । এই সমুদ্র স্রোতটি পৃথিবীজুড়ে জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। ভারতের জলবায়ু এল নিনো দ্বারা প্রভাবিত হয়—যে বছর এল নিনো প্রবাহিত হয় সে বছর পুবালি জেটবায়ু দুর্বল হয়। ফলে ভারত মহাসাগরের উচ্চচাপ অন্যান্য বছরের মতো শক্তিশালী হয় না। ফলে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। মৌসুমি বায়ু ভারতে বিলম্বে আসে। তখন ভারতে মৌসুমি বৃষ্টি কম হয় এবং খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

10. লা-নিনার প্রভাব : ‘লা-নিনা’ শব্দের অর্থ ‘ছোট্ট বালিকা’। এল-নিনোর ঠিক বিপরীত অবস্থা হল লা-নিনা। গড়ে প্রায় 2-7 বছর অন্তর প্রশান্ত মহাসাগরে নিরক্ষরেখা বরাবর প্রবাহিত শীতল সমুদ্রস্রোতকে লা-নিনা বলে। এর প্রভাবে ভারতে মৌসুমি বায়ু অতি সক্রিয় হয় এবং প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। তাই লা-নিনা সৃষ্টির বছরগুলিতে ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে।


ভারতের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Indian Climate)


ভারত মৌসুমি জলবায়ুর দেশ । মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য এত স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় যে, ভারতকে আদর্শ মৌসুমি জলবায়ুর দেশ রূপে গণ্য করা যায়। ভারতের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল --

1. জলবায়ুর প্রকৃতি : ভারত ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত এবং এখানে মৌসুমি বায়ুর প্রাধান্য দেখা যায়। তাই ভারতের জলবায়ুকে ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির বলা হয়।

2. আর্দ্র গ্রীষ্মকাল, শুষ্ক শীতকাল : ভারতে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টি হয় বলে গ্রীষ্মকাল আর্দ্র প্রকৃতির হয়। শীতকালে শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতের সর্বত্র বৃষ্টিপাত হয় না। তাই শীতকাল শুষ্ক হয়।

3. বায়ুপ্রবাহ : ভারতে দুই বিপরীতধর্মী বায়ু প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।

4. ঋতু পরিবর্তন : ভারতের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঋতু পরিবর্তন। মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের ওপর ভিত্তি করে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এবং শীতকালে প্রধান চারটি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয়।

5. গ্রীষ্মকালে ‘লু’ এবং শীতকালে তুষারপাত : গ্রীষ্মকালে কিছু কিছু স্থানে বিশেষত মধ্য ও পশ্চিম ভারতে অত্যন্ত উয় এবং শুষ্ক ‘লু’ বায়ু প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে, শীতকালে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত ভারতীয় জলবায়ুর একটি বৈশিষ্ট্য।

6. খরা ও বন্যার সৃষ্টি : ভারতের জলবায়ুতে অনাবৃষ্টির কারণে খরা এবং অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা একটি অতি পরিচিত ঘটনা। 

7. ঝড়-ঝঞ্ঝা : গ্রীষ্মকালে সৃষ্ট কালবৈশাখী, বরদৈছিলা,আম্রবৃষ্টি, ধূলিঝড় আঁধি, শরৎকালে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন এবং শীতকালে আগত পশ্চিমি ঝঞ্ঝা ভারতের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

8. বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন : ভারতের মোট বৃষ্টিপাতের 90% ঘটে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে। কিন্তু মৌসুমি বায়ু ভারতের সর্বত্র সমানভাবে বিচরণ না করায় বৃষ্টিপাতের আঞ্চলিক বৈষম্য প্রকট। যেমন – উত্তর-পূর্ব ভারতে যেখানে গড় বৃষ্টিপাত 300-350cm সেখানে মধ্যভারতে 100-150cm ও রাজস্থানে 50 cm-এর কম।

9. সমভাবাপন্ন ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ু : ভারতের দক্ষিণে সমুদ্রের অবস্থানের জন্য বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন প্রকৃতির, কিন্তু সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন প্রকৃতির।

10. তুষারপাত : ভারতের সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে তুষারপাত ঘটতে দেখা যায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ