Header Ads Widget

Responsive Advertisement

মহীসঞ্চরণ বা মহাদেশীয় সঞ্চারণ(Drifting of Continents) তত্ত আলোচনা করো

         মহীসঞ্চরণ বা মহাদেশীয় সঞ্চারণ 


    পৃথিবীতে বিভিন্ন মহাসাগর ও মহাদেশসমূহের উদ্ভব এবং অবস্থান সংক্রান্ত ধারণা প্রদানের ক্ষেত্রে মহীসঞ্চরণ বা মহাদেশীয় সঞ্চারণ মতবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হলেন জার্মান আবহবিদ অধ্যাপক আলফ্রেড ওয়েগনার।মহীসঞ্চরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ধারণা প্রদান করেন আলফ্রেড ওয়েগনার 1912 খ্রিস্টাব্দে, যদিও 1922 খ্রিস্টাব্দে ওয়েগনারের 'Die Entstehung der Continente and Ozane' নামক বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে ধারণাটি প্রচারিত হয়।


মূল ধারণা : ওয়েগনার পুরাজলবায়ু, পুরাজীববিদ্যা, পুরাউদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থ সংক্রান্ত প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করেন যে, কার্বনিফেরাস যুগে সমস্ত ভূখণ্ডগুলি একত্রিতভাবে একটি ভূখণ্ডরূপে অবস্থান করত, ওয়েগনার যার নাম দেন প্যানজিয়া (Pangae) প্যানজিয়া যে বিশাল জলভাগ দ্বারা বেষ্টিত ওয়েগনার তার নামকরণ করেন প্যানথালাসা (Panthalassa)। সগনারের মতানুসারে, মহাদেশীয় ভূত্বক বা সিয়াল মহাসাগরীয় ভূত্বক বা সিমার ওপরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। প্যানজিয়ার উত্তরে অবস্থিত উত্তর আমেরিকা, ইউরােপ ও এশিয়াকে একত্রে লরেসিয়া (Laurasia) বা আঙ্গারাল্যান্ড (Angaraland) এবং দক্ষিণে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, উপদ্বীপীয় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকাকে একত্রে গন্ডোয়ানাল্যান্ড (Gondwanaland) নামে অভিহিত করা হয়।

                কার্বনিফেরাস যুগে দক্ষিণ মেরু দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালের কাছে অবস্থিত ছিল। আফ্রিকাকে কেন্দ্রে রেখে তার চারদিকে দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা প্রভৃতি মহাদেশ অবস্থিত ছিল। ওয়েগনারের মতে, কার্বনিফেরাস যুগে প্যানজিয়া ভেঙে গিয়ে বিভিন্ন দিকে সারিত হয়। পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের মহাদেশগুলি যথাক্রমে নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় উয় জলবায়ু এবং মেরুদেশীয় ও মেরুকুও প্রদেশীয় শীতললবায় অএলে অবস্থিত ছিল। মহীস-রণের কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরােপ প্রভৃতি মহাদেশগুলিতে উষ্ণ ক্রান্তীয় জলবায়ুর পরিবর্তে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর উপস্থতি লক্ষ করা যায় এবং ভারত, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া ক্রমাগত নিরক্ষীয় অঞলের দিকে সঞ্চারিত হতে থাকে । ওয়েগনারের ধারণানুসারে, শুধু দক্ষিণ মেরু নয়, উত্তর মেরুরও বিভিন্ন যুগে স্থান পরিবর্তিত হয়।


মহাদেশীয় সরণের জন্য দায়ী শক্তিসমূহ : ওয়েগনারের মতে, মহাদেশগুলি প্যানৰ্জিয়া থেকে ভাঙনের পরে নিরক্ষীয় দিকে ও পশ্চিম দিকে সঞ্চারিত হয় এবং এর জন্য দায়ী প্রধান দুটি শক্তি হল 1)বৈষম্যমূলক অভিকর্ষ শক্তি এবং 2)জোয়ারি শক্তি। 

1) বেষম্যমূলক অভিকর্ষ শক্তি (Differential Gravitational Force) : মহাদেশগুলির নিরক্ষরেখার দিকে শহমের জন্য ওয়েগনার বৈষম্যমূলক অভিকর্ষজ শক্তিকে দায়ী করেন। মূলত সঞ্চরণশীল বস্তু বা মহাদেশগুলির ভরকেন্দ্র ও সক্রণশীল মতানশালির প্রবতা কেন্দ্রের মধ্যে সম্পর্কের ওপর এই শক্তি নির্ভর করে থাকে। সাধারণত বতা ও অভিকর্ষজ শক্তি পরস্পরের বিপরীতে ক্রিয়াশীল থাকলেও পৃথিবীর উপবৃতীয় গােলাকৃতির জন্য ভরকেন্দ্রের নীচে প্লবতার কেন্দ্র অবস্থান করে এবং ফলস্বরূপ সৃষ্ট শক্তির প্রভাবে মহাদেশগুলি নিরক্ষরেখায় দিকে সরে যায় ।45° অক্ষরেখায় এই শক্তির তীব্রতা সর্বাধিক ।

2) জোয়াড়ি শক্তি (Tidal Force) : মহাদেশগুলি পশ্চিম দিকে সরলের জন্য সূর্য ও চন্দ্রের জোয়ারি শক্তি দায়ী বলে ওয়েগনার মনে করেন। দীর্ঘসময় ধরে কার্যকারী থাকায় এই শক্তির পরিমাণ কম হলেও প্রভাব যথেষ্ট বেশি বলে ওয়েগনার মনে করতেন। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও জোয়ারি শক্তির প্রভাবে মহাদেশগুলি ক্রমশ পশ্চিম দিকে সরে যায়।


মহীসঞ্চরণ এর প্রমাণসমূহ : মহীসঞ্চরণ এর পক্ষে ওয়েগনার প্রধানত যে প্রমাণগুলির উল্লেখ করেছেন, সেগুলি নিম্নরূপ 

1)Gig-saw-fit : ওয়েগনারের ধারণানুসারে, একটি খণ্ড-বিখণ্ড পােস্টকার্ডকে যেমন পাশাপাশি রেখে যুক্ত করা সম্ভব, তেমনি আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাশ্ববর্তী মহাদেশগুলিকে একসঙ্গে যুক্ত করা যায়। এই ঘটনাটি জাক্সটাপজিশন (Juxtapos tion) বা জিগ-স-ফিট (igsw-fit) নামে পরিচিত। যেমন—দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অন্তরীপ ও বিপরীত দিকে দক্ষিণ আমেরিকার ভাঁজের মধ্যে মিল লক্ষ করা যায়।

2) ভূ-তাত্ত্বিক প্রমাণ : আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে অবস্থিত কালিডােনিয়ান ও হাসিনিয়ান পর্বতেরগাঠনিক প্রকৃতির সাদৃশ্য মহাদেশীয় সরণকে প্রমাণ করে ।

3)কার্বনিফেরাস যুগে কয়লার অস্তিত্ব : বর্তমানে উত্তর গােলার্ধের অন্তর্গত যেসব শীতল নাতিশীতােষ্ণ অঞ্চল থেকে কয়লা আহরণ করা হচ্ছে ওয়েগনারের ধারণানুসারে সেই অঞ্চলগুলি অতীতে কোনাে সময়ে ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞলে অবস্থিত থাকায় এই অঞ্চলগুলিতে ঘন ক্রান্তীয় অরণ্য ও কয়লার স্তরের উৎপত্তি ঘটেছে।

4)প্রাক-কার্বনিফেরাস যুগের হিমবাহের অস্থিত্ব : প্রাক কার্বনিফেরাস যুগের হিমবাহের অস্তিত্ব দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ ভারত, দক্ষিণ-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে লক্ষ করা যায়। যদিও এই অঞ্চল গুলির বর্তমান অবস্থান অনুসারে কখনই সব কটি অঞ্চলে একই হিময়ুগের অবস্থিত থাকা সম্ভব নয়। এই ঘটনাটি উক্ত অঞ্চলগুলির কার্বনিফেরাস যুগের পূর্ববর্তী সময়ে একত্রে অবস্থানের বিষয়টিকেই প্রমাণ করে।

5)বৃত্তচাপীয় দ্বীপমালা গঠন : ওয়েগনার উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম দিকে সরণের ফলে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গঠন হয়েছে বলে মনে করেন। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ গুলি গঠনের সাথেও মহাদেশীয় সরণের সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়।

6)পর্বত গঠন : ওয়েগনার তার মহীসঞ্চরণ তত্ত্বের সাহায্যে পৃথিবীতে বিভিন্ন পর্বত গঠনের ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। ওয়েগনারের মতে, পশ্চিমদিকে সঞ্চরণশীল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সম্মুখবর্তী অংশের পলি সমুদ্রবক্ষের (সিমা) শিলার দ্বারা বাধা পেয়ে প্রাপ্ত হয় এবং রকি ও আন্দিজ পর্বত গড়ে ওঠে। যদিও পরবর্তীকালে এই ধারণাটি যথেষ্ট সমালোচিত হয়। 

7)জীবাশ্ম সম্পর্কিত প্রমাণঃ গ্লোসােপটারিস উদ্ভিদের জীবাশ্ম দক্ষিণ আফ্রিকা ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে পাওয়া যায়। অতীতে এই স্থানগুলি একত্রে গন্ডােয়ানাল্যান্ড রূপে অবস্থান করত এবং অনুকূল জলবায়ুতে এই উদ্ভিদ প্রজাতিটির বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে মহায়ে সরণের ফলে মহাদেশ ও বিভিন্ন অঞ্চলগুলি বিভিন্ন দিকে সঞ্চারিত হলেও উদ্ভিদটির জীবাশ্ম রয়ে গিয়েছে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে পার্মিয়ান যুগের অবক্ষেপ থেকে মের্সাসরাস নামক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যায়।


মহীসঞ্চরণ তত্ত্বের সমালােচনা :

1) Gig-saw-fit এর ভ্রান্ত ধারণা : দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার তার মধ্যে প্রায় 16” ব্যবধান রয়েছে, যা jig saw fit এর ধারণাকে শান্ত বলে প্রমাণ করে।

2)সঞ্চারনের জন্য শক্তির অভাবঃ প্লবতা ও জোয়ারি শক্তির প্রাবল্য এত অধিক নয় যে মহাদেশ গুলি কে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে সীমা র ওপর দিয়ে সেগুলিকে সঞ্চারিত করতে পারে। মহাদেশ গুলির পশ্চিমে সরণের জন্য জোয়ারি শক্তিকে বর্তমানের তুলনায়10 মিলিয়ন গুণ শক্তিশালী হতে হবে, যা বাস্তবে অসম্ভব ।

3)জীবাশ্মের বন্টন : অধ্যাপক লেক-এর মতে, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিন আমেরিকা, ভারতের দক্ষিণাশে, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা ছাড়াও সাইবেরিয়া, উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তান, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে গ্লোসোপটেরিস -এর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যার ব্যাখ্যা মহীসঞ্চরণ তত্তের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

 4)মহীসঞ্চরণের সময়কাল : কার্বনিফেরাস যুগের আগে মহাদেশীয় সরণ ঘটেছিল কিনা সেই বিষয়ে ওয়েগনার কোনাে উল্লেখ করেননি।

 5)পর্বত গঠন তত্ত্বের সমালােচনা : সিমার উপর দিয়ে সিয়ালের সঞ্ণের সময়ে সিয়ালের সম্মুখভাগ ভাজপ্রাপ্ত হয়ে পর্বত সৃষ্টি সম্পর্কে ওয়েগনার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে সম্পর্কে বিজ্ঞানী স্টিয়ার্স সংশয় প্রকাশ করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ