Header Ads Widget

Responsive Advertisement

সমস্থিতি মতবাদ (Isostasy Theory) আলোচনা করো

                  সমস্থিতি (isostasy)


          Isostasy বা সমস্থিতি শব্দটি নেওয়া হয়েছে গ্রিক শব্দ isostasios' শব্দ থেকে যার অর্থ equipoise' হলো সম অবস্থান অথবা state of balance' ভারসাম্যের অবস্থা । 1889 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ভূবিজ্ঞানী ডাটন সর্বপ্রথম সমস্থিতি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তার মতে পৃথিবীপৃষ্ঠের বৃহৎ উত্থিত অঞ্চল ,পর্বতমালা মালভূমি ও সংলগ্ন নিম্ন ভূমির মধ্যে সমস্থিতি অবস্থা বা ভারসাম্যের অবস্থা বিদ্যমান। ডাটন এর মতে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন ভূমিরূপের উচ্চতা তাদের ঘনত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । অন্যভাবে বলা যায় যে , অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ভূমিরূপের অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্ব লক্ষ্য করা যায় এবং অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতা বিশিষ্ট ভূমিরূপের বেশি ঘনত্ব লক্ষ্য করা যায়। 

সমস্থিতির ধারণার ভিত্তিসমূহ (Basis of the Concept of Isostasy) :

∆ অভিকর্ষজ বল সম্পর্কিত ধারনা : পৃথিবীর অভিগত গোলাকৃতির জন্য বিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুসারে পৃথিবীর সব স্থানে অভিকর্যের মান সমান হবে না। নিরক্ষীয় অঞ্চলের দুরত্ব পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলে অভিঅর্যের মান কম, কিন্তু মেরুর দিকে ক্রমশ এই মান বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা ছাড়া শিলার ঘনত্ব উচ্চতার তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গে (উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে অভিকর্ষজ মান হ্রাস পায়) অভিকর্ষের মানের পরিবর্তন ঘটে। ০ 


∆ বুগের-এর অভিকর্ষজ অসঙ্গতি : ফরাসি ভূতত্ত্ববিদ পিয়ের বুগের (Pierre Bouguer) 1735 খ্রিস্টাব্দে আন্দিজ পর্বতমালা অভিকর্ষজ মান নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে চিম্বােরাজো পর্বতের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সমীক্ষা করেন। এই সময়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে, যন্ত্রের ওলন বা প্লাম্বরেখা নিউটনের অভিকর্ষ নির্ণয় পদ্ধতি অনুসারে যতটা মাত্রায় আন্দিজের দিকে সরে যাওয়া উচিত তা প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে না। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে আন্দিজ পর্বতমালায় যে পরিমাণ পদার্থের ভর রয়েছে তার তুলনায় আন্দিজ পর্বতের আকর্ষণ খুব কম। তবে বুগের-এর এই পর্যবেক্ষণ সেই সময়ে বিজ্ঞানী সমাজে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। 


∆ জর্জ এভারেস্ট কর্তৃক অভিকর্ষজ অসঙ্গতি পর্যবেক্ষণ : বুগের-এর সমীক্ষার পরবর্তীকালে 1859 খ্রিস্টাব্দে ভারতের তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্ট ভারতের কালিয়ানা ও কালিয়ানপুরের মধ্যে অক্ষাংশের পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। নক্ষত্রের উন্নতিকোণ ও ত্রিভুজাকৃতি সমীক্ষা এর মাধ্যমে অক্ষাংশ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্যার এভারেস্ট লক্ষ্য করেন যে, দুটি পদ্ধতির মানের মধ্যে 5.23 সেকেন্ড কৌণিক পার্থক্য রয়েছে, যা 268 মিটার ভূমির দৈর্ঘ্যের সমান। থিওডােলাইটের প্লাম্বববের উপর হিমালয়ের আকর্ষণের প্রভাবে এই পার্থক্য ঘটেছে বলে মনে করা হয়।


∆ প্রাট এর সমীক্ষা :1855 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত বিজ্ঞানী তিনি প্র্যাট এই কৌণিক পার্থক্যের কারণ নির্ধারণের জন্য হিমালয় পর্বত কে দায়ী করেন। তার মতে যেহেতু কালিয়ানা হিমালয় পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত সেহেতু কালিয়ানা থেকে পর্যবেক্ষণ কালে হিমালয় পর্বত থিওডোলাইট এর প্লামরেখাকে উত্তর দিকে আকর্ষন করছে ‌। ফলে প্লামরেখা উলম্ব অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে আর এর সাপেক্ষে নির্ণীত নক্ষত্রের উন্নতি কোণ অক্ষাংশে নির্ণয় ভুল হয়ে গিয়েছে।


       1855 খ্রিস্টাব্দে প্রাট বলেছিলেন যে হিমালয়ের শিলাস্তরের ঘনত্ব মহাদেশীয় শিলাস্তরের ন্যায় 2.7 গ্রাম/ ঘনসেমি । প্রাপ্ত শিলার ঘনত্বের মাধ্যমে তিনি হিমালয়ের ভর নির্ণয় করেন এবং সেই হিসাবে রেখা কতটা বিচ্যুত হবে তাও স্থির করেন। এই হিসাব অনুযায়ী প্লামরেখার বিচ্যুত হওয়া উচিত ছিল 15.885" কিন্তু প্রকৃত বিচ্যুতি ঘটে 5.23" । ফলে হিমালয় কে যতটা আকর্ষণ করার কথা ছিল ততটা করেনি কারণ হিমালয়ের শিলাস্তরের ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম।


সমস্থিতির প্রধান তত্ত্বসমূহ (Major Theories of Isostasy) :

1] জর্জ এইরি-র তত্ত্ব : স্যার জর্জ এর মতে মহাদেশ গুলি হালকা সিয়াল দ্বারা তৈরি এবং মহাসাগর গুলি ভারী সীমা দ্বারা তৈরি। তিনি আরো স্পষ্টভাবে বলেন যে হিমালয় শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠের উপর এই নেই ভূপৃষ্ঠের নিচেও অপেক্ষাকৃত ভারী শিলার মধ্যে এর মূল (root) রয়েছে।

             অন্যভাবে বলা যায়, হিমালয় অপেক্ষাকৃত ঘন ম্যাগমার মধ্যে ভাসমান এবং এর বেশিরভাগ অংশই অন্তঃস্তরের (substratum) মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। যেমন বোটের বেশিরভাগ অংশই জলের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। এটা ভাসমান নীতি মেনে ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে হিমশৈল বা আইসবার্গের একাংশ জলের ওপরে থাকলে এর নয় ভাগ জলের নিচে নিমজ্জিত থাকে। 

সমস্থিতি মতবাদ

             এরির মতে হিমালয়ের আকর্ষণ ক্ষমতা যতটা ধরা হয়েছিল তার থেকে কম কারণ হিমালয়ের হালকা পদার্থের মূল বা শিকড় অন্তঃস্তরের মধ্যে অনেক গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত । এরি আর অনুমান করেন যে ভূপৃষ্ঠের যে অংশ যত উঁচু হবে সেই অংশের শিকড় তত নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে আর ভূপৃষ্ঠের উপরে যত কম অংশ থাকে , নিম্নেও তত অংশ থাকবে। এরির মতে ভূমির বিভিন্ন স্তম্ভের ঘনত্ব( উদাহরণ -পর্বত ,মালভূমি ও সমভূমি ইত্যাদি)একই থাকে কিন্তু স্তম্ভের দৈর্ঘ্য বা গভীরতা অসমান হয়। এটি সহজেই প্রমাণ করা যায় যদি বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের কাঠের টুকরো গুলিকে জলের মধ্যে রাখা হয় তাহলে এগুলি দৈর্ঘ্য অনুযায়ী জলের মধ্যে নিমজ্জিত হবে।

সমস্থিতি মতবাদ

সমালোচনা : এরির এই তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললেন এই তত্বের কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এরির মতে প্রত্যেক উচ্চ ভূমি ভাগের উচ্চতা অনুসারে তার শিকার বা মুল ভূগর্ভের নিম্নে নিমজ্জিত হয়েছে সেই অনুসারে হিমালয়ের শিকর বা মূল ভূগর্ভের নীচে রয়েছে 79,632 মিটার (1:9 অনুপাতে) ।এটি যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে এর দৈর্ঘ্য শিকড় বা মুল উচ্চ তাপমাত্রা জন্য গলে যাবে যেহেতু তাপমাত্রা 32 মিটার গভীরতা 1°c বৃদ্ধি পায় । তবে পরবর্তীতে হাইস্কানেন এর গবেষণার পর অনেক ভূতাত্ত্বিক বর্তমানে এরির মতকে সমর্থন করতে শুরু করেন। হাইস্কনেন এর মাতে গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর ঘনত্ব এমন ভাবে বৃদ্ধি পাবে যে উষ্ণতা ও চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পদার্থটি গলে যাবে না।


2] প্রাট এর তত্ত্ব : তিনি দেখিয়েছেন যে কালিয়ানা ও কালিয়ান পুরের প্লামরেখা এর বিচ্যূতি হওয়া উচিত ছিল কিন্তু প্রকৃত বিচ্যুতি ঘটেছে অর্থাৎ যে পরিমাণ বিচ্যুতি ঘটার কথা ছিল সে পরিমাণ ঘটেনি ।হিমালয় পর্বত তারপর অপেক্ষা কম আকর্ষণ করছে। সুতরাং হিমালয় হালকা পদার্থ দ্বারা তৈরি অর্থাৎ হিমালয়ের শিলাস্তরের ঘনত্ব কম। তিনি আরও বলেছিলেন যে পর্বতমালার ঘনত্ব মালভূমি অপেক্ষা কম, মালভূমি অঞ্চলের শিলাস্তরের ঘনত্ব সমভূমি অপেক্ষা কম, সমভূমি অঞ্চলের শিলাস্তরের ঘনত্ব সমুদ্র তলদেশের ঘনত্ব অপেক্ষা কম। প্রাট এর মতে ভূ-অভ্যন্তরের এমন একটি তল রয়েছে যার ওপরে ভূমি ভাগের বিভিন্ন স্তম্ভের ঘনত্বের পরিবর্তন হয় কিন্তু এর নিচে পদার্থের ঘনত্বের পরিবর্তন ঘটে না, এই তলকে প্রতিবিধান তল বলে। 

প্রাট এর সমস্থিতি মতবাদ মূল ধারণা হলো ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরের গভীরতা সমান থাকে কিন্তু ঘনত্বের তারতম্য ঘটে। আমরা যদি ভূত্বকে কতগুলো সংলগ্ন স্তম্ভ রূপে কল্পনা করি তাহলে ওই প্রতিবিধান তলে প্রত্যেক স্তম্ভ সমান চাপ প্রয়োগ করবে।এইরূপ অবস্থায় স্তম্ভের শিলার ঘনত্ব অনুযায়ী স্তম্ভের উচ্চতা নির্ভর করবে‌ । হালকা পদার্থ গঠিত স্তম্ভের উচ্চতা পদার্থ গঠিত স্তম্ভের উচ্চতা থেকে বেশি হবে। এখানে সম প্রস্থচ্ছেদ যুক্ত বিভিন্ন দাতব্য স্তম্ভগুলোর উচ্চতা এমনভাবে স্থির করা হয়েছে যে ভাসমান অবস্থায় একটা নির্দিষ্ট তলে এরা সবাই সমান চাপ দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ