Header Ads Widget

Responsive Advertisement

নার্তিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি বা জীবনচক্র [Origin or life cycle of Temperate Cyclone]

 নাতিশীতোষ্ণ বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাত         (Temperate or Mid Latitude Cyclone)


সংজ্ঞা (Definition) : পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে 35°-65° অক্ষাংশের মধ্যে দুটি বিপরীতধর্মী বায়ুপ্রবাহ অর্থাৎ উষু, আর্দ্র ও হালকা ক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জ এবং শীতল ও ভারী মেরু বায়ুপুঞ্জের সম্মিলনের ফলে যে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয় তাকে মধ্য অক্ষাংশীয় বা নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বলে।

বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics) : (i) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত স্থলভাগ ও সমুদ্রে সৃষ্টি হয়ে থাকে। (ii) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট সময় না থাকলেও প্রধানত শীতকালে এই ঘূর্ণবাত বিকাশলাভ করে। (iii) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত উয় ও শীতল বায়ুপুঞ্জের সম্মিলনের ফলে সৃষ্ট সীমান্তের প্রভাবে উদ্ভূত হয়। (iv) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকার, প্রায় বৃত্তাকার, লম্বাকৃতির বা 'V' আকৃতির হয়ে থাকে। (v) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে নিম্নচাপ ও চারপাশে আবদ্ধ সমপ্রেষরেখার অবস্থান লক্ষ করা যায়। (vi) এক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহ উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে যথাক্রমে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ও ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রবাহিত হয়। (vii) এই প্রকৃতির ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র ও বহিঃসীমার মধ্যে প্রায় 10-20 মিলিবার চাপের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যদিও এই পার্থক্য অনেকসময় 35 মিলিবারও হতে পারে। (viii) মধ্য-অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাতের ব্যাস গড়ে 150-3000 কিমি হয়ে থাকে। (ix) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উল্লম্ব বিস্তার প্রায় 10-12 কিমি পর্যন্ত হয়।


নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাতের গঠন সম্পর্কিত তত্ত্ব বা মতবাদ [Theories]] : নাতিশীতোয় বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রধানত দুটি তত্ত্ব সর্বাধিক প্রচলিত আছে—

[A] মেরু সীমান্ত তত্ত্ব বা তরঙ্গ তত্ত্ব [Polar Front Theory or Wave Theory] : নরওয়ের প্রখ্যাত আবহবিদ ভিলহেম বার্কনেস (Vilhelm Bjerknes) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের গঠন সম্পর্কে প্রথম আলোকপাত করেন। আলোচ্য ঘূর্ণবাতের গঠন বৈশিষ্ট্য হল— 

1. বিপরীতধর্মী বায়ুপুঞ্জের মিলন : ভি. বার্কনেস-এর মতে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত গঠিত হয় দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত ভৌত গুণাবলি (Properties) সম্পন্নবায়ুপুঞ্জের দ্বারা। যেমন—মহাদেশীয় মেরু বায়ুপুঞ্জ (cP) অত্যন্ত শীতল ও শুষ্ক কিন্তু সামুদ্রিক ক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জ (mT) উয় ও আর্দ্র প্রকৃতির। 

2. সীমান্ত গঠন : বিপরীতধর্মী উষ্ণবায়ুপুঞ্জ ও শীতল বায়ুপুঞ্জ পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসলে উভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে প্রথমে একটি অদৃশ্য সীমান্ত বা, বায়ুপ্রাচীর (front) সৃষ্টি হয়। পরে এই সীমান্ত বা বায়ুপ্রাচীর বরাবর বাঁদিকে শীতল সীমান্ত (cold front) এবং ডানদিকে উষ্ণ সীমান্ত (worm front) গঠিত হয় । 

3. বায়ুপ্রাচীর বা সীমান্তের ঢাল : নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতে শীতল সীমান্তের ঢাল উষ্ণ সীমান্তের ঢালের তুলনায় খাড়াই হয় । 

4. মেঘ ও বৃষ্টি : শীতল বায়ু সীমান্তের সঙ্গে নিম্বোস্ট্যাটাস (বর্ষণস্তর মেঘ), স্ট্যাটাস (স্তরমেঘ), অল্টোস্ট্র্যাটাস (অধিক উঁচু স্তরমেঘ), সিরোস্ট্যাটাস (ঊর্ধ্বস্তর মেঘ) সৃষ্টি হয়। এই মেঘে বৃষ্টিপাত হয়। 

5. ক্ষেত্রগঠন : নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতে সাধারণত দু’প্রকারের ক্ষেত্র অঞ্চল (Sector) গড়ে ওঠে(i) উষ্ণ ক্ষেত্র (Warm sector) ও (ii) শীতলক্ষেত্র (Cold sector) 

কার্যপদ্ধতি : বিপরীতধর্মী বায়ুপুঞ্জের মাঝে অবস্থিত সীমান্তের বিস্তার 100-200 কিমি এবং দৈর্ঘ্য 1500-3000 কিমি পর্যন্ত হয়। মাঝে মাঝে উন্ন ও আর্দ্র পশ্চিমা বায়ু শীতল ও শুষ্ক মেরুবায়ুর গতিপথে ঢুকে পড়ে। এর ফলে সীমান্ত অঞ্চলের (frontal zone) বায়ুমণ্ডলে এক অস্থির অবস্থা ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বায়ুমণ্ডলের এই সংক্ষোভ-এর কারণেই মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণবাত পশ্চিমা বায়ুর গতিপথ অনুসারে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায় এবং এভাবে ক্রমশ উচ্চতর অক্ষাংশের দিকে এগোতে থাকে।


[B] ব্যারোক্লিনিক তরঙ্গ তত্ত্ব [Baroclinic wave theory] : নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের গঠন প্রসঙ্গে এই তত্ত্বে বলা হয় যে—সাধারণ অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে সমচাপ পৃষ্ঠ [Isobaric surface] বা সমঘনত্ব পৃষ্ঠ (equal density surface) বা সমচাপতল বা সমোষ্বতল পরস্পরের পৃথিবী সমান্তরালে অবস্থান করে। একে ব্যারোট্রপিক অবস্থা বলে। কিন্তু কোনো কারণে যদি পরস্পর সমান্তরাল না থেকে সমোয়তল সমচাপ পৃষ্ঠকে তির্যক বা উল্লম্বভাবে ছেদ করে, তাহলে সমচাপপৃষ্ঠ বরাবর তাপমাত্রার পাথর্ব্যজনিত যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাকে ব্যারোক্লিনিক অবস্থা বলে। এই ছেদকতল বরাবর সমচাপ্রপৃষ্ঠতে তাপমাত্রা নিচের দিকে হঠাৎ কমে যায় বা ওপরের দিকে হঠাৎ বেড়ে যায় বলে বায়ুচাপের চার্ল খুব খাড়া হয়। এর ফলে ওপরে বাতাসের গতিবেগ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং নিচের বাতাস দ্রুত ওপরে র্উঠতে থাকে। এরকম অবস্থায় নিচে যে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করার জন্য চারপাশের বাতাস প্রবল বেগে ছুটে আসে। আগত এই বায়ু কোরিওলিস বলের প্রভাবে কম আবর্তিত হয়ে ঘুর্ণবাতের সৃষ্টি হয়।


নার্তিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি বা জীবনচক্র [Origin or life cycle of Temperate Cyclone]

নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি বা জীবনচক্র সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটি হল নরওয়ের আবহবিদ ভি. বার্কনেস , জি. বার্কনেস ও এইচ সোলবার্গ প্রদত্ত ‘মেরু বায়ুপ্রাচীর তত্ত্ব' [Polar Front theory]। এই তত্ত্বটি 'তরঙ্গ তত্ত্ব' [Wave theory], 'বার্জেন তত্ত্ব' [Bergen theory], ‘বায়ুপ্রাচীর সম্বন্ধীয় তত্ত্ব' [Frontal theory] প্রভৃতি নামেও পরিচিত। একে মেরুসীমান্ত মতবাদও বলা হয়। নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও বিকাশে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য হল মেরুসীমান্ত তত্ত্ব । নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র এতে 6টি পর্যায়ে বায়ুমণ্ডল উল্লেখ করা হয়েছে।

1. প্রথম পর্যায় (First Stage) : বিপরীত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ও অভিমুখবিশিষ্ট দুটি বায়ুপুঞ্জ অর্থাৎ উষ্ণ ও শীতল বায়ুপুঞ্জ এই পর্যায়ে সম্মিলিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি বায়ুপুঞ্জ পরস্পরের সমান্তরালে প্রবাহিত হয় এবং স্থিতিশীল সীমান্ত গড়ে ওঠে।

2. দ্বিতীয় পর্যায় (Second Stage) : এই পর্যায়ে উষ্ণ ও শীতল বায়ুপুঞ্জ পরস্পরের ক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং অস্থিতিশীল তরঙ্গের মতো সীমান্ত গঠিত হয়। এই পর্যায়কে সদ্যোজাত পর্যায় বলা হয়।

3. তৃতীয় পর্যায় (Third Stage) : উষ্ণ সীমান্তে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জ প্রবল ও প্রকট হয়ে স্ফীতির আকারে শীতল বায়ুপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে এবং শীতল সীমান্ত বরাবর শীতল বায়ু বেশি সক্রিয় হয়ে উষ্ণ বায়ুকে ঠেলে ওপরে উঠে যেতে বাধ্য করে। এর ফলে উষ্ণক্ষেত্রটি সংকীর্ণতর ও শীতলক্ষেত্রটি প্রশস্ততর হতে থাকে।

4. চতুর্থ পর্যায় (Fourth Stage) : এই পর্যায়ে প্রবল আলোড়নে শীতল ও উষ্ণ সীমান্তের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম কোণ সৃষ্টি হয় এবং তরঙ্গ শীর্ষ তীক্ষ্ণ আকার ধারণ করে। এই পর্যায়ে ঘূর্ণবাত সৃষ্টির প্রক্রিয়া বা সাইক্লোজেনেসিস (Cyclogenesis) তীব্রতর হয় এবং এই পর্যায়কে অঙ্কুশন সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় বলা হয়। এই পর্যায়ে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু শীতলবায়ু দ্বারা অবরুদ্ধ ও ঘনীভূত হয়ে মেঘাচ্ছন্নতা ও প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটে

5. পঞ্চম পর্যায় (Fifth Stage) : এই পর্যায়ে শীতল সীমান্ত অতি দ্রুত হারে অগ্রসর হয়ে উয় সীমান্তকে ধরে ফেলে এবং উভয় সীমান্ত মিলে, একটি মাত্র অভিন্ন সীমান্তে পরিণত হয়।এর ফলে উষ্ণবায়ুপুঞ্জের কিছুটা অংশ মূল বায়ুপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং শীতল বায়ুপুঞ্জ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে অবস্থান করে। এই প্রক্রিয়াটিকে অন্তর্লীন বা অঙ্কুশান (Occlusion) বলে এবং পর্যায়টিকে অকুশান পর্যায় বলা হয়।

6. ষষ্ঠ পর্যায় (Sixth Stage) : শীতল বায়ুপুঞ্জ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় উষ্ণ বায়ুপুঞ্জটির উয়তা ও আর্দ্রতার জোগান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এটি আর কোনো শক্তি পায় না। এবং এর ফলে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জটি ক্রমশ শীতল, বায়ুপুঞ্জের মধ্যে মিশে যেতে থাকে। ফলে ঘূর্ণবাতের মৃত্যু ঘটে।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ